১১৫৭ সালের এপ্রিল মাস । সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আপন চাচাতো ভাই খলীফা সালেহ - এর গভর্নর সাইফুদ্দীনকে লিখলেন-
‘তোমরা খাঁচায় বন্দী রং-বেরংয়ের পাখি নিয়ে ফুর্তি করো । নারী আর সুরার প্রতি যাদের এতো আসক্তি, তাদের জন্য সৈনিক জীবন খুবই বেমানান ।
খলীফা সালেহ আর তার বংশজ গভর্নর সাইফুদ্দীন গোপনে মুসলিম খেলাফতের চিরশত্রু ক্রুসেডারদের চক্রান্তে ফেঁসে গেলেন । খেলাফতের রাজভাণ্ডার-মণি -মুক্তা, হীরা-জহরত, দিনার-দেহরাম দিয়ে এই দুই শাসক ক্রুসেডারদের প্ররোচিত ও সহযোগিতা করতে লাগলেন সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে । সুলতান আইউবীকে হত্যা করার চক্রান্ত আঁটা হলো ।
একদিন ঠিক কাঙ্ক্ষিত সুযোগটি এসে গেলো ক্রুসেডারদের হাতে । তাঁরা মুসলিম শাসকদের মধ্যেই তালাশ করছিলো দোসর । খলীফা সালেহ স্বেচ্ছায় ক্রুসেডারদের সেই ভয়ানক চক্রান্তে পা দিলেন । খলীফা ও ক্রুসেডারদের সমন্বিত চক্রান্তে দু’ দু’বার হত্যার উদ্দেশ্যে আইউবীর উপর আঘাত হানা হলো । দু’বারই সৌভাগ্যবশত বেঁচে গেলেন সুলতান সালাহুদ্দীন । তছনছ করে দিলেন ঘাতকদের সব চক্রান্ত । আঘাতে-প্রত্যাঘাতে পরাস্ত করলেন শত্রুদের । ফাঁস হয়ে গেল গভর্নর সাইফুদ্দীনের চক্রান্তের খবর ।
গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে ক্রুসেডারদের দোসর গাদ্দার সাইফুদ্দীন ঘর-বাড়ী, বিত্ত-বৈভব ফেলে পালিয়ে গেলো । গভর্নরের আবাস থেকে উদ্ধার হলো বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ, বিলাস-ব্যসন । গভর্নরের বাড়িতে পাওয়া গেলো দেশী-বিদেশী অনিন্দসুন্দরী যুবতী, তরুণী, রক্ষিতা । এদের কেউ ছিলো নর্তকী, কেউ গায়িকা, কেউ বিউটিশিয়ান, কেউ ম্যাসেঞ্জার । সবই ছিলো সাইফুদ্দীনের মনোরঞ্জনের সামগ্রী ও ইসলামী খেলাফত ধ্বংসের জঘন্য উপাদান ।
সাইফুদ্দীনের বাড়ীতে আরো পাওয়া গেলো নানা রঙের নানা প্রজাতির অসংখ্য পাখি । দেয়ালে দেয়ালে ঝুলানো ছিলো বিভিন্ন ভঙ্গিমার নগ্ন, অর্ধনগ্ন নারীদের উত্তেজক অশ্লীল ছবি । সুরাভর্তি অসংখ্য পিপা ।
সালাহুদ্দীন খাচার বন্দী পাখীদের মুক্ত করে দিলেন । গভর্নরের বাড়ীতে বন্দী সেবিকা, নর্তকী, বিউটিশিয়ান ও শিল্পী-তরুণীদের আপনজনদের কাছে পৌছিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন । তারপর সাইফুদ্দীনকে লিখলেন-
‘তোমরা দু’জনে কাফের-বেঈমানদের দ্বারা আমাকে হত্যা করাবার অপচেষ্টায় মেতেছো । কিন্তু একবারও ভেবে দেখোনি, তোমাদের এই চক্রান্ত মুসলিম খেলাফতের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে । দুই দুইবার আমাকে হত্যা করার জন্যে লোক পাঠিয়েছো; কিন্তু সফল হতে পারোনি । আবার চেষ্টা করে দেখো, হয়তো সফল হবে । তোমরা যদি আমাকে এ নিশ্চয়তা দাও যে, আমার মৃত্যুতে ইসলামের উন্নতি হবে, মুসলমানদের কল্যাণ হবে, তাহলে কা’বার প্রভূর কসম করে বলছি, আমি তোমাদের তরবারী দিয়ে আমার শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করিয়ে তোমাদের পদতলে উৎসর্গ করতে অসিয়ত করে যাবো । আমি তোমাদের শুধু একটি কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কাফের-বেঈমানরা কখনো মুসলমানদের বন্ধু হতে পারে না । ইতিহাস তোমাদের চোখের সামনে । আমাদের সোনালী অতীতের দিকে একবার ফিরে দেখো । আশ্চর্য, রাজা ফ্রাংক-রেমণ্ডের মত প্রচণ্ড ইসলাম বিদ্বেষী অমুসলিম শাসকরা তোমাদের সাথে একটু বন্ধুত্বের অভিনয় করলো, আর অম্নি তোমরা তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহস যুগিয়েছো! ওরা যদি সফল হতো, তাহলে ওদের পরবর্তী প্রথম শিকার হতে তোমরা-ই । এরপর হয়তো দুনিয়া থেকে ইসলামী খেলাফত মুছে ফেলার কাজটিও সমাধা হতো । তোমরা তো যোদ্ধা জাতির সন্তান । সৈন্য ও যুদ্ধ পরিচালনা তোমাদের ঐতিহ্যের অংশ । অবশ্য প্রত্যেক মুসলমান-ই আল্লাহর সৈনিক আর আল্লাহর সৈনিক হওয়ার পূর্বশর্ত ঈমান ও কার্যকর ভূমিকা । তোমরা খাঁচার পাখি নিয়ে ফুর্তি করো । মদ-নারীর প্রতি যাদের এত আসক্তি, সৈনিক জীবন ও যুদ্ধ পরিচালনা তাদের জন্যে খুবই বেমানান । আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, তোমরা আমাকে সহযোগিতা করো । আমার সাথে জিহাদে শরীক হও । যদি না পারো, অন্তত আমার বিরুদ্ধাচারণ থেকে বিরত থাকো । আমি তোমাদের অপরাধের কোন প্রতিশোধ নেবো না । আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন । আমীন ।
-সালাহুদ্দীন আইউবী
গভর্নর সাইফুদ্দীন গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নতুন চক্রান্তে মেতে উঠলো । সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর চিঠি পড়ে তার মধ্যে দ্বিগুণ প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলো । যোগ দিলো ইহুদী হাসান ইবনে সাব্বাহ’র ঘাতক স্কোয়াডের সাথে । শুরু হলো নতুন চক্রান্ত । হাসান ইবনে সাব্বাহ’র স্কোয়াড দীর্ঘ দিন ধরে ফাতেমী খেলাফতের আস্তিনের নীচে কেউটে সাঁপের মতো বিরাজ করছিলো ।
পড়ুন পরবর্তি পর্ব : এখানে ক্লিক করুন

0 মন্তব্যসমূহ